কোম্পানীগঞ্জ
প্রকৃতিকন্যা সিলেটের জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর। যত দূরে চোখ যাবে চোখে পড়বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সাদা পাথর আর পাথর। ওপারে ভারতের উঁচু পাহাড়ে ঘেরা সবুজের মায়াজাল। সেখান থেকে নেমে আসা ঝরনার অশান্ত শীতল স্বচ্ছ নীল জল, সাদা পাথর আর পাহাড়ের সবুজ মিলেমিশে যেন একাকার।
ধলাইয়ের বুকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পাথরের বিছানা শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে হাজার গুণ। যে কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রকৃতিপ্রেমী হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন ছুটে আসেন এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে। তবে এখানে আনন্দ উপভোগ করতে এসে অনেকেই পড়েন বিপাকে।
সিলেট শহর থেকে বাস, প্রাইভেটকার, সিএনজি, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহন নিয়ে ভোলাগঞ্জ নৌকাঘাট এসে ৮শত টাকা দিয়ে নৌকা রিজার্ভ করে যেতে হয় সাদাপাথরের মূল পর্যটন স্পটে। এখানে নেই কোন হোটেল-রিসোর্ট। নেই কোন সরকারি ব্যবস্থাপনা, যার ফলে পর্যটকদের সাথে থাকা মোবাইল, টাকা ও মূলবান মালপত্র রাখতে হয় বিভিন্ন অনিরাপদ স্থানে। তাই প্রায় সময় ঘটছে অকাঙ্খিত ঘটনা। চুরি হচ্ছে পর্যটকদের মোবাইল ফোন, টাকাসহ মূলবান মালামাল। চুরি হওয়া মালামাল উদ্ধারে কোন ধরণের সহযোগিতা পাওয়া যায় না। ট্যুরিস্ট পুলিশ না থাকায় কারো কাছে অভিযোগ করেও লাভ হচ্ছে না। এতে করে ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর পর্যটন কেন্দ্রে আসার আগ্রহ হারাচ্ছে পর্যটকেরা। যদিও ব্যক্তিগতভাবে এখানে মালামাল রাখার জন্য রয়েছে অল্প কিছু ব্যবস্থা। তা খুবই সামান্য। তবে পর্যটকদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনও।
বর্তমানে সাদা পাথরের জনপ্রিয়তা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পাওয়ায় পর্যটকদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে আগত পর্যটকদের আগের মতো নিরাপত্তা দেওয়া কিংবা নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব হচ্ছে না। পর্যটকরা ঝুঁকি নিয়ে প্রবল স্রোত উপেক্ষা করে নদীর এপার-ওপার হচ্ছেন। যার ফলে গত দুই বছরে পানিতে ডুবে নিহত হয়েছে তিন পর্যটক। গেল একমাসে বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত পর্যটকদের মোবাইল, টাকা, ব্যাগ চুরিসহ ১০টি ঘটনা ঘটেছে।
গত সোমবার ঢাকা থেকে আগত পর্যটক ইয়াছিন আরাফাত বলেন- সাদা পাথর পর্যটন স্পট অনেক সুন্দর ও মনোরম। স্বচ্ছ পানিতে গোসল করে মনটা জুড়িয়ে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আমার মোবাইল, টাকা ও ব্যাগ চুরি হয়েছে।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন- গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যটন কেন্দ্রে নেই কোন ট্যুরিস্ট পুলিশ ও নিরাপত্তা জোরদার। এসব ঘটনার কারণে ভোলাগঞ্জ সাদাপাথরে আসতে পর্যটকদের আগ্রহ হারাবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একজন পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ি বলেন- ‘প্রায় পর্যটকরা এমন অভিযোগ করেন। এটা আমাদেরও খারাপ লাগে। নিরাপত্তা জোরদার বাড়ানো উচিত।’
স্পটে থাকার নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া থাকলেও বেশিরভাগই তা মানছেন না। অনেকে সেখানে সন্ধ্যার পর পর্যন্ত অবস্থান করছে। সীমান্তবর্তী ও নির্জন হওয়ায় এখানে সন্ধ্যার পর অবস্থান নিরাপদ নয়। তাই উপজেলা প্রশাসন সন্ধ্যার আগে আগে সাদাপাথর থেকে সরে আসার নির্দেশনা দিয়ে রেখেছে।
এমতাবস্থায় দেশের এই জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রে পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। সিলেটের সকল পর্যটন কেন্দ্রে ট্যুরিস্ট পুলিশ থাকলেও সাদাপাথরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্রে এখনো ট্যুরিস্ট পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়নি।
কসমেটিকস ব্যবসায়ী আব্দুল কুদ্দুস খন্দকার বলেন, ‘জনপ্রিয় একটি পর্যটন স্পট সাদাপাথর। এখানে ট্যুরিস্ট পুলিশ নেই যা খুবই দুঃখজনক। পর্যটক ও ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তার জন্য দ্রুত এখানে ট্যুরিস্ট পুলিশ দেওয়ায় আহ্বান করছি।’
কোম্পানীগঞ্জ ফটোগ্রাফি সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মো. শরীফ আহমেদ বলেন, প্রায় সময় পর্যটকদের মোবাইল, মানি ব্যাগসহ মূল্যবান মালামালের চুরির ঘটনা ঘটে। সীমান্ত এলাকায় এখানে বিজিবি দায়িত্বে রয়েছে। সীমান্ত রক্ষার পাশাপাশি তারা পর্যটকদের নিরাপত্তা দেয়। কিন্তু পর্যটন স্পটে ট্যুরিস্ট পুলিশ থাকলে পর্যটকেরা সর্বোচ্চ নিরাপত্তা পাবে বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে সিলেট ট্যুর গাইড এসোসিয়েশনের সভাপতি হুমায়ুন কবির লিটন বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন থেকে ডিসি অফিসে ও ট্যুরিস্ট পুলিশের অফিসে যোগাযোগ করছি সাদাপাথরে ট্যুরিস্ট পুলিশ দেওয়ার জন্য। তাদের কাছে দাবি জানিয়েছি সাদাপাথর একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র এখানে ট্যুরিস্ট পুলিশ অত্যন্ত জরুরি।’
কোম্পানীগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি আবুল হোসেন বলেন, ‘সাদাপাথর বাংলাদেশের মধ্যে একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। প্রতিদিন এখানে প্রায় ৪-৫ হাজার পর্যটক আসেন। এই পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য এখানে ট্যুরিস্ট পুলিশ থাকা জরুরি।’
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুমন আচার্য বলেন, সাদা পাথর একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্পট। এখানে ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রয়োজন। ট্যুরিস্ট পুলিশে দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সাথে কথা বলেছি। আশা করছি এখানে দ্রুত ট্যুরিস্ট পুলিশের ব্যবস্থা হবে।
এ ব্যাপারে ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরুল ইসলাম জানান, প্রকৃতি কন্যা সিলেটের জনপ্রিয় পর্যটন স্পট সাদা পাথর। পর্যটকদের নিরাপত্তা কথা চিন্তা করে এখানে ট্যুরিস্ট পুলিশের একটি টিম দেওয়া জরুরী। কিন্তু জনবল সংকট থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে ট্যুরিস্ট পুলিশের একটি ইউনিট দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
তবে পর্যটকদের সব অভিযোগ-অনুযোগ বিবেচনায় নিয়ে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। সরকারের মেগা প্রকল্পের আওতায় ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর এলাকায় তৈরি করা হবে ভাসমান ঘাট, শৌচাগারসহ অত্যাধুনিক সুবিধাসম্বলিত অবকাঠামো। এর আওতায় রয়েছে নিরাপত্তার বিষয়টিও। এসব মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে সিলেটের পর্যটন উন্নয়নে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে মনে করছেন জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম।
0 coment rios: