বুধবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২১

দুর্গা-পূজা : ঐতিহ্য, আধুনিকতার সাথে চাই প্রাণের পরশ

 



দুর্গা পূজায় অজস্র মানুষ ঢাকা ছেড়ে যায়, যেমন ছেড়ে যায় দু’টি ঈদে। ঢাকার কর্পোরেট সংস্কৃতির প্রভাবযুক্ত ঝলমলে, প্রাচুর্যপূর্ণ, আধুনিকতার ছোঁয়া লাগানো পূজোগুলো সব মানুষকে ধরে রাখতে পারেনা। ঢাকার পূজাতে আয়োজনের ঘাটতি নেই। তার পরও মানুষ ঢাকা ছেড়ে চলে যায় গ্রামে কিংবা মফস্বল শহরে। ঈদের ছুটিতে স্বাভাবিক ভাবে ট্রেন, বাস, লঞ্চের ভীড়টা চোখে পড়ে। ট্রেন, বাসের ছাদে, লঞ্চের ডেকে মানুষ প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটে চলে নাড়ির টানে, প্রাণের আহব্বানে। দুর্গা পূজায় জনসংখ্যার হারে কিছুটা কম মানুষ যায়, তাই তাঁদের যাওয়াটা চোখে পড়ে না। কিন্তু যে কারণে ঈদে মানুষ ছুটে চলে প্রিয় জনের কাছে একই কারণে দুর্গা পুজাতে ও মানুষ ঢাকা ছেড়ে যায় শেকড়ের কাছাকাছি। এই যে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে, “ফিরে চল্, ফিরে চল্, ফিরে চল্ মাটির টানে/যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে” রবীন্দ্রনাথের গানের এই মাহাত্ম্য বাংলাদেশের মানুষের চেয়ে আর কেউ বেশি উপলব্ধি করেন বলে মনে হয় না। প্রতিটি জাতীয় উৎসব-পর্বে তাঁরা মাটির টানে উৎসে ফিরে যেতে চান, স্বজনদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে চান। গ্রামের সঙ্গে, মফস্বল শহরের বন্ধনটা যে ছিন্ন হয়নি, মানুষ তখন অনুভব করে। সেই বন্ধনটাই মানুষকে টেনে নিয়ে যায় শেকড়ের গভীরে। ঢাকার পূজোর প্যান্ডেলগুলোতে অজস্র বিজলি বাতির ঝলক আছে। মূর্তির মধ্যে আধুনিকতা এমন কি উত্তর আধুনিকতাও আছে। প্যান্ডেলগুলোর সাজ একেক বছর এক এক রকম। প্রতিযোগিতা বড় বেশি। টাকা পয়সার অভাব নেই। দেশের নামকরা কোম্পানি কিংবা মাল্টিন্যাশন্যাল কোম্পানি গুলো টাকা নিয়ে বসে আছে। শুধু প্ল্যান করেন। টাকা দেবে গৌরি সেনের মতো কোম্পানিগুলো। সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা মূল ধারার মিডিয়ার মাধ্যমে কোলকাতার ছোঁয়া এসে লেগেছে ঢাকার পূজোয়। ঢাকাতে তাই কোলকাতার মতো থিম পূজো শুরু হয়েছে সম্প্রতি। বনানী, কলাবাগান, উত্তরার পূজোতে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীর সন্ধ্যা গুলোতে আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দেশের নামী দামী শিল্পীরা সে অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করেন। অনুষ্ঠান গুলো লাইভ প্রচার করে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই যোগদান করেন। ঝলমলে পোষাক পরে নগর নন্দন, নগর নন্দিনীরা বের হন পূজা দেখতে। শুধু কী নন্দন, নন্দিনী? সকল বয়সের মানুষ পূজার প্যান্ডেল গুলোতে ঘুরে বেড়ান। সব কিছু বড় গোছানো। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উঁকি দিয়ে দেখতে হয়না, মাল্টিমিডিয়ার ম্যাগা পর্দায় চোখের সামনে প্রিয় শিল্পীরা যেন হাজির হন। পূজো প্যান্ডেলের আশে পাশে অজস্র গাড়ি পার্ক করা। সব কিছু যন্ত্রের মতো চলছে। সব কিছু রবোটিক হলে কী মাটির মানুষের ভালো লাগে? এতো গোছানো, এতো প্রোগ্রাম করা পূজা শাশ্বত বাঙালির হৃদয়ের গহীনে থাকা অনুভুতিকে ঠিক যেন নাড়া দিতে পারে না। যেমন দুর্গা পূজায়, মাটির মূর্তির প্রাণ প্রতিষ্ঠা না হলে পূজা করা যায় না, ঠিক সে রকম প্রাণময়, প্রাণ প্রাচূর্যে ভরা মানুষ কাছে না থাকলে পূজোর আনন্দ পরিপূর্ণ হয় না।
কী আছে অজপাড়া গাঁয়ের কিংবা মফস্বল শহরের পূজোয় যা ঢাকা মহানগরের পূজোয় নেই। নিতান্ত মফস্বল শহরে বেড় ওঠা আমার মতো অতি সাধারণ মানুষ নিজের অভিজ্ঞতাটা বিনিময় করতে পারি। মানুষ কী শুধু পূজার আনন্দ উপভোগ করতে যায়? আমার মনে হয় পূজাটা একটা বড় উপলক্ষ, এই সুযোগে মানুষ প্রকৃতির কাছেও ছুটে যায়। যে প্রকৃতি এখন তার স্বাভাবিকতা নিয়ে ঢাকার মানুষের সামনে উপস্থিত হতে পারেনা। ঢাকা শহরের অপরিকল্পিত ভবনগুলো যেমন শহরে ঢুকতে দেয় না কোনো বিশুদ্ধ বাতাস তেমনই বেরোতেও দেয় না শহরের দূষিত হাওয়া। শহরে তাই বসন্ত আসেনা, আসেনা কোন ঋতু। আমি নিতান্ত মফস্বল শহরে বেড়ে ওঠা মানুষ।শহরটির নাম সিলেট। ওই শহরে আমি আমার শৈশব, কৈশোর, প্রাকযৌবন পর্যন্ত কাটিয়েছি। আমার শহরে এখনো আগুণ রঙের পলাশ ফোটে, কোকিলের ডাক শোনা যায়, বসন্ত সাজ সাজ রবে জ্বল জ্বল করে তার উপস্থিতি জানায়। অনেক বাড়িতে এখনো শিউলি ফুলের গাছ আছে, শহরের আশেপাশের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে অজস্র কাশ ফুলের বাগান আছে, থোকা থোকা শিউলি আর কাশ ফুল এখনো বলে দেয় শরৎ এসে গেছে। প্রতি বার পূজাতে গিয়ে যখন প্রকৃতির কোলে বসে সজীব নিশ্বাস নিতে পারি, তখন প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা এবং মা দুর্গার প্রতি ভালোবাসা একাকার হয়ে যায়।
শুধু কী প্রকৃতিই মানুষকে টানে? এই যে ছোট শহরে কিংবা গ্রামে বছর ঘুরে দেখা হয় প্রিয় মানুষ গুলোর সাথে সেটা কী কিছু নয়। অনেক প্রিয় বন্ধু আছেন, প্রিয়জন আছেন তাঁরা দেশে থাকেন না, দীর্ঘ দিন পর দেশে আসেন তাঁদের সাথে যখন দেখা হয়, তখন মনে হয় এরকম অমুল্য সাক্ষাতই তো উৎসব। সবার মনেই একজন শিশু বাস করে। উৎসব এলে মনের ভেতরে থাকা সেই শিশুটি বের হয়ে আসে। শৈশব, কৈশোর কিংবা যৌবনের বন্ধুর সাথে যখন দেখা হয় পূজোর প্যান্ডেলে দীর্ঘ বছর পর; তখন হৃদয়ের কোঠর থেকে রবি ঠাকুর বেরিয়ে এসে বলেন, “মাঝে হল, ছাড়া ছাড়ি গেলেম কে কোথায়, আবার দেখা যদি হল সখা প্রাণের মাঝে আয়”।
ঢাকা শহরের হাজার মানুষের ভিড়ে এরকম ঘটা খুব স্বাভাবিক নয়। মানুষ যখন তার উৎসে ফিরে তখন ভেতরে এরকম একটি আশা নিয়ে যায়, হয়তো পাড়ার মাঠে বৃষ্টির জলে ভিজে ভিজে যাদের সাথে ফুটবল খেলেছি, গোল্লাছুট খেলেছি তাদের কারো কারো সাথে দেখা হলেও হয়ে যেতে পারে এবারের পূজাতে। প্রতি বছর পূজাতে এরকম পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা দেখা হয়ে যায়।
মফস্বল শহরের পূজো গুলোতে ধীরে ধীরে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও এখনো একটা অকৃত্রিম ভাব আছে। এখনো ডেকোরেশন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের থেকে পূজার আনুষ্ঠানিকতা বড়। আর পূজার মধ্যে একধরনের অনানুষ্ঠানিক ধরন আছে। পূজার অঞ্জলি নিয়ে গভীর ভক্তি বোধ কাজ করে। এখনো সনাতনী ঢাক বাজে, এখনো সনাতনী আরতী অনুষ্ঠিত হয়।
মানুষ তাঁর শৈশব থেকে যে অকৃত্রিমতা দেখে অভ্যস্থ, সেই অকৃত্রিম পরিবেশ আছে এখনো গ্রামের কিংবা মফস্বল শহরের পূজা গুলোতে। আর একটি বিশেষ বিষয় হলো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রতিটি পাড়ায় চমৎকার আয়োজন, খুব যে পরিকল্পিত তা’ কিন্তু নয়। পাড়ার মেয়ে, পাড়ার ছেলে কিংবা শহরের প্রতিভাবান উঠতি গায়কেরা মন কেড়ে নেন পূজার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান গুলোতে। আমার বেড়ে ওঠা শহরের আশে পাশে অজস্র চা বাগান আছে, সেই চা বাগান গুলোর পূজা অনন্য। ঢেউয়ের মতো টিলা গুলোর মধ্যেই স্থায়ী পূজা মন্ডপে চা বাগানের দুর্গা পূজা হয়ে থাকে। দুর্গা মূর্তি মনে হয় প্রকৃতির কোলে , প্রকৃতির সাজে সজ্জিত হয়ে চা বাগানের মন্ডপে উপস্থিত হন। প্রতিটি পূজা মন্ডপে রাতের বেলা আমাদের চিরায়ত সংস্কৃতির অবিচ্ছিন্ন মাধ্যম যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সেই যাত্রা দেখতে সিলেট শহর এবং আশে পাশের গ্রাম থেকে অজস্র মানুষ উপস্থিত হন। “মহিষাশুর মর্দিনী” কিংবা “দুর্গতি নাশিনী দুর্গা” এরকম নামের যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হয় প্রতিটি চা বাগানে। যাত্রাপালা আয়োজনে আছে আন্তরিক নিবেদন, স্থানীয় শিল্পীদের প্রচেষ্টায় এবং অতি স্বাভাবিক অভিনয়ে এই যাত্রা পালা প্রতি বছর মুগ্ধ করে স্থানীয় দর্শকদের।
এবার আসি সামগ্রিক আয়োজন নিয়ে। ঢাকা শহরের পূজাকে সুন্দর করে তুলার প্রচেষ্টার অভাব নেই আয়োজকদের। পূজার সাথে সাথে আধুনিক প্রযুক্তি এবং প্রতিযোগিতা যুক্ত হলে পূজা কিছুটা যান্ত্রিক হয়ে যায়। প্রযুক্তির বাঁধ ভাঙ্গা উন্নয়নের সাথে সাথে প্রযুক্তিগত সুবিধা পূজাতে যুক্ত হবে এটাও স্বাভাবীক। মফস্বল শহর কিংবা গ্রামেও প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে। লাগুক এতে জাত যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।একটি জিনিস মনে রাখতে হবে আধুনিকতার সাথে সাথে যেন ঐতিহ্য হারিয়ে না যায়।
যে কোন জাতির জন্য ঐতিহ্যকে ধরে রাখা গর্বের। আমরা চাই ঐতিহ্যের সাথে এসে যেন পূজাতে আধুনিকতা যুক্ত হয়। এমন আধুনিক পূজা আমরা চাইনা যে পূজাতে শুধু আধুনিকতা আছে কিন্তু সনাতনী ঐতিহ্য নেই। ঐতিহ্য যখন আধুনিকতার সাথে যুক্ত হয় তখনই আয়োজন হয় সৃজনশীল অনুষ্ঠানের। যে আয়োজনে প্রাণ থাকে, যে আয়োজনে আন্তরিকতা মোছে যায়না। আর প্রিয়জনের ছোয়া, তা’তো কোন ভাবেই সম্ভব নয় দুই কোটি মানুষ বসবাস করে যে শহরে এবং এটাই স্বাভাবিক। তাই মাটির টানে যারা ফিরে যাবে প্রিয়জনের কাছে তারাতো যাবেই কিন্তু পূজোর আয়োজন যেখানেই হোক ঢাকা কিংবা যে কোন গ্রামে অথবা মফস্বল শহরে, আয়োজনটিতে যেনো হৃদয়য়ের উষ্ণ ছোঁয়া থাকে। পূজোর অঞ্জলি যেন হয় হৃদয় অঞ্জলি। যদি তাই করা যায়, তাহলে আমরা দুর্গা পূজার যে উদ্দেশ্য সে উদ্দেশ্যকে সফল করতে পারবো। পূজার মাধ্যমে আমাদের আশে পাশে ঘুরে বেড়ানো অপশক্তি, অশুভ শক্তির বিনাশ হবে এবং পূজা হবে প্রকৃত অর্থে সকল মানুষের। আমরা সর্বজনীন, প্রাণবন্ত, আন্তরিক ভক্তিরসে পরিপূর্ণ পূজা দেখতে চাই সারা বাংলাদেশে।


শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: